ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থা আসবে না। প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেছেন। অনেকেরই জানা হয়ে গেছে, বাংলাদেশ ২০২৪ সালে ইকোনমিস্টের বর্ষসেরা দেশ নির্বাচিত হয়েছে। সবচেয়ে সুখী বা ধনী নয় বরং গত ১২ মাসে কোন দেশ সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে, সেই বিচারে বর্ষসেরা দেশ বেছে নেওয়া হয়। বাংলাদেশকে বর্ষসেরা দেশের খেতাব দেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন ও বাংলাদেশের নবযাত্রা শুরুর বিষয়টিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইকোনমিস্টের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক প্যাট্রিক ফোলিস। বাংলাদেশ বর্ষসেরা খেতাব পাওয়ায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিক্রিয়া জানতে চান প্যাট্রিক ফোলিস। উত্তরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত আনন্দিত, অত্যন্ত গর্বিত। সত্যিকার অর্থেই আমরা একটি বড় পরিবর্তন ঘটিয়েছি। ছাত্রদের কারণেই অভ্যুত্থান ঘটেছে। তখন থেকে আমরা বলছি, একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই।’ প্যাট্রিক ফোলিস জানতে চান, বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থা ফিরে আসার কিছু ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কর্মকর্তারা, বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন? জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান, বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে না। দেশের তরুণরা খুবই উদ্যমী। ধর্মের বিষয়ে তারা পক্ষপাতহীন। এই তরুণরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চান। উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ যা, সেটাই তুলে ধরেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। বাকীরা হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও অন্যান্য। শত শত বছর ধরে তারা পাশাপাশি বসবাস করেছে শান্তি ও সম্প্রীতির সঙ্গে। তাদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, বিরোধ-সংঘাত ধর্মীয় কারণে কখনোই দেখা যায়নি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিত। এই যে সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, এর পেছনে নিয়ামক ভূমিকা রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের। ইসলাম তাদের অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের প্রতি সদাচার ও সমতা প্রদর্শনের শিক্ষা দিয়েছে। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিক্ষা দিয়েছে, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খৃষ্টান হিসেবে নয়। রাষ্ট্রীয় ও মানবিক অধিকারের ক্ষেত্রে তাদের প্রতি বিষম আচরণ করতে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছে। এদেশের মুসলমানরা যুগের পর যুগ ধরে ইসলামের এই নির্দেশনা ও শিক্ষা অনুসরণ করে আসছে। তার মতই অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষও সহিষ্ণু, সুহৃদয়, পারস্পরিক ভ্রাতৃসম্মন্ধে আবদ্ধ। এ কারণেই বাংলাদেশ শান্তি ও সম্প্রীতির অনন্য দেশ হিসেবে খ্যাতে হয়ে আছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেন এদেশে ইসলামি চরমপন্থা আসবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন, তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশের মানুষের ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা, পঠন-পাঠন তাকে বলে দিয়েছে, বাংলাদেশে ইসলামি কেন, কোনো ধরনের চরমপন্থার উত্থানের আশঙ্কা নেই। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর হাসিনা ও মোদি মিলে সংখ্যালঘু কার্ড খেলছেন একের পর এক হিন্দু নির্যাতনের কল্পিত কাহিনী প্রচার করে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছেন। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধানোর অসৎ উদ্দেশ্যও তাদের রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু তাদের এই যৌথ অপচেষ্টা এদেশের জাগ্রত ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক দল ও সরকার সফলভাবে প্রতিহত করেছে ও করে যাচ্ছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে ইসলামি চরমপন্থার জুজুর ভয় দেখিয়েছেন। মাঝে মাঝেই ‘জঙ্গী’ ধরার নাটক করেছেন। নিজের অপকর্মকে ঢাকা দেওয়া ও ক্ষমতা নিরাপদ করার জন্য এটাকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার অন টেরর শুরুর পর থেকে বিশ্বব্যাপী ইসলামি চরমপন্থী খোঁজা আরম্ভ হয়েছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশে আগ্রাসন চালানো হয়েছে। নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। বাড়িঘর ও স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। ধন-সম্পদ লুট করা হয়েছে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াকে রীতিমত ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নানা রকম কাহিনী ও গল্প সৃষ্টি করে বিশ্ববাপী ইসলামোফোবিয়ার বিস্তার ঘটানো হয়েছে। মুসলমানদের সভ্যতার শত্রু ও মানবতার দুশমন হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি চরম বিদ্বেষই এর মূলে। ওয়ার অন টেররের দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বড় সমর্থক হয়ে যায় ভারত। ভারতে মুসলমানদের ওপর দমন-পীড়ন, অত্যাচার-নির্যাতন চালানোর ক্ষেত্রে এটা মোক্ষম হাতিয়ারে পরিণত হয়। লক্ষ করা বিষয়, ভারতে বিশেষ করে বিজেপি শাসনকালে মুসলমানদের ওপর যেভাবে জুলুম চলছে, সে রকম জুলুম অতীতে আর কখনো হয়নি। অথচ মানবতার ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রভৃতি দেশ ভারতের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করছে না। বলে রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার অন টেররের প্রতি ভারতের সমর্থন ইন্দো-মার্কিন সম্পর্কের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পাকিস্তানকে পরিহার করে ভারতকেই এ অঞ্চলে প্রধান মিত্র বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
স্বৈরাচার হাসিনা ভারতের দাসী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। মোদির সঙ্গে তার সখ্য গভীর। মোদির ইসলাম ও মুসলমান বিদ্বেষ তাকে প্রভাবিত করেছে। তার ইসলাম ও মুসলিমবিমুখতা যুক্তরাষ্ট্রকেও আকর্ষণ করেছে। এমন একটি ন্যারেটিভ তিনি প্রচার করেছেন যে, ইসলামি চরমপন্থার উত্থান একমাত্র তার পক্ষেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। তার এই প্রচারের সাথী হয়েছে ভারত। বিনা ভোটের নির্বাচনে তিনি দফায় দফায় ক্ষমতায় এসেছেন। তাকে নিঃশর্ত সমর্থন করেছে ভারত। ভারতের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রও নীরব থেকেছে। ছাত্র-জনতা ভারতের অতিশয় বিশ্বস্থ শিখন্ডি হাসিনাকে বিদায় করে দিয়ে ভারতের কতটা ক্ষতি করেছে, সহজেই অনুমেয়। আসলে এ দেশে শেখ হাসিনার শাসন ছিল না, ছিল ভারতের শাসন। বাংলাদেশকে এই সাড়ে ১৫ বছরে ভারত যথেচ্ছ শোষণ ও শাসন করেছে। এখন সেই শোষণ-শাসনের ইতি ঘটেছে। তাই ভারত বাংলাদেশের পটপরিবর্তনকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। হাসিনা নেই, কাজেই ইসলামি চরমপন্থা গেড়ে বসতে পারে, এই ন্যারেটিভ ভারতের। তাকে সমর্থন করছে যুক্তরাষ্ট্র। হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানো ও ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এই ন্যারেটিভ প্রচার করা হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ যে, তিনি এই ন্যারেটিভ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছেন। সৎসাহসের সঙ্গে সত্য উচ্চারণ করেছেন। কে না জানে, এ দেশের মুসলমানরা কখনোই চরমপন্থা পছন্দ করে না। এখানে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা হয়েছে সুফী-দরবেশদের দ্বারা, যারা ছিলেন বিনয়ী, অসম্প্রদায়িক, মানবিক, সহৃদয় এবং চরিত্রমাধুর্যে অতুলনীয়। এদেশের মানুষ তাদের উত্তরাধিকার বংশপরম্পরায় বহন করছে। অতীতে কখনো কখনো বিপথগামী হয়ে কেউ কেউ বা কিছু লোক চরমপন্থা অনুসরণের চেষ্টা করেছে বটে, তবে তারা সফল হয়নি। দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এটাই দেশের মানুষের প্রকৃত চরিত্র। এটাই বাংলাদেশ। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই বাংলাদেশের কথাই বলেছেন। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, গণধিকৃত হাসিনা সরকারের সময়ে বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থা উত্থানের আশঙ্কা নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ছাড়াও গ্রন্থাদি রচনা করে বিলি করা হয়েছিল। কিছু পত্রপত্রিকা বিভিন্ন সময়ে একই প্রচারণা চালিয়েছে। এসব যে নিতান্তই মিথ্যা, বানোয়াট ও বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার দৃঢ় উচ্চারণের মধ্য দিয়ে চিরায়ত বাংলাদেশ ও তার অধিবাসীদের প্রকৃত পরিচয় সুস্পষ্ট করেছেন। সরকারের বহিঃপ্রচার বিভাগের উচিত, বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার জন্য প্রচার-প্রচারণা ও গ্রন্থাদি প্রকাশ করা, যাতে বাংলাদেশ সম্পর্কে আসল ধারণা বিদেশিরা পেতে পারে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘণকুয়াশার কারণে ৭ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু
ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৫০
আওয়ামী পন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুক্তরাজ্য শাখা বিএনপি নেতার মতবিনিময়
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক শরিফুলের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ
আ.লীগের দোসর সালাম আলী এখন বিএনপির সভাপতি প্রার্থী!
ঘুস নেওয়ার অভিযোগ, টিউলিপ সিদ্দিককে যুক্তরাজ্যে জিজ্ঞাসাবাদ
তালাক নিয়ে যুক্তরাজ্যে যেতে চান বাশার আল-আসাদের স্ত্রী
গভীর রাতে মেসে ছাত্রীদের বিক্ষোভ, মালিকের দুই ছেলেকে পুলিশে সোপর্দ
প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস
৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়
বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়
ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড
গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ
এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ
আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?
হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে
ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন
দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা
নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই
ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে